Wednesday 8 December 2021

প্রাপ্তি--অদিতি ঘটক


প্রাপ্তি

অদিতি ঘটক


কেসটা সাজাতে গিয়ে বারবার তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, অথচ হাতে সময় খুব কম। তাড়াতাড়ি এফ. আই. আর. এর খসড়াটা  তৈরি করতে হবে। পরমার্থর মত দক্ষ উকিলের কাছে যা একেবারে রুটিন ওয়ার্ক। তবুও, এই তবুও খোঁচাটাই ওকে কাবু করে দিচ্ছে। অপরাধ, নিরপরাধ সমস্ত সংজ্ঞা গুলিয়ে যাচ্ছে। কত কঠিন কেসই তো ওর কাছে এসছে এই রকম  উভয়সঙ্কটে ওকে কখনো পড়তে হয়েছে কি?

মেয়েটা যেন ওর রাতের স্বপ্নে হানা দিচ্ছে, করুন মুখে বলছে বলুন,"আমি অপরাধী?" তত পরমার্থর অস্বস্তি বাড়ছে? কাল পুলিশের কাছে যাওয়ার ডেট। মেয়ের বাপের বাড়ি, ডাক্তার, মেয়ে সবার বিরুদ্ধে তার মক্কেল অভিযোগ দায়ের করবে

 সঠিক ভাবে গুছিয়ে লিখতে হবে --


"একটি প্রাণ কে পৃথিবীর আলো দেখার অধিকার কেন দেওয়া হল না !বাবার মত কেন নেওয়া হল না ?"------

এই শেষ কথাটা কয়েকটা প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে, না এই শেষ কথাটা নয় এই  কেসটা ই বেশ কয়েকটা প্রশ্ন তুলছে,  চিকিৎসা বিজ্ঞানের যদি অগ্রগতি না হত তাহলে কি আমরা মেনে নিতাম না ! লক ডাউন একটা শিশু হত্যার জন্য কতটা দায়ী ? কারণ মেয়েটি পিতৃগৃহে গিয়ে আর আসতে পারেনি।  দু জায়গাতেই পরিস্থিতির বিপাকে সঠিক চিকিৎসাও করাতে পারেনি। বাবাও সময় মত সশরীরে পৌঁছতে পারেনি। ডাক্তার কি পারে শুধু মায়ের ও তার বাপের বাড়ির মতের ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে ?যেখানে মায়ের প্রাণ সংশয় নেই ! যে শিশু কয়েক ঘন্টার অতিথি মাত্র তাকে জন্ম দেওয়ার দায় কি মায়ের আছে? বাবার অধিকার কতটা ? একটি ভ্রূণ যা গর্ভাবস্থায় সম্পূর্ণ বিকশিত হয়নি তাকে কি পৃথিবীতে নিয়ে আসা উচিত ? না ভূমিষ্ঠ হওয়ার অধিকার তারও আছে? কোন ত্বত্ত মানা উচিত ? যোগ্যতমের উত্তরাধিকার না মানবতা? 

অ..নেক অ--নেক জটিল প্রশ্ন যা বার বার পরমার্থকে আয়নার সামনে দাঁড় করাচ্ছে, নিয়ে যাচ্ছে ওর ছায়াছন্ন অতীত সরণিতে।

 পরমার্থ 'ল' আর মধুপর্ণা জেনেটিক্স তবুও ওদের মনে বসন্তের রঙধরতে কোনো অসুবিধা হয়নি। বহুদিন ওরা হাত ধরাধরি করে গোধূলির হলুদ আলো মাখতে মাখতে কৃষ্ণচূড়া বনের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গেছে। নদীর ছলাৎ ছল ওদের বুকেও তুলেছে তরঙ্গের দোলা।  কতবার পার্কের গেটকিপারকে ঘুষ দিয়ে বাড়িয়ে নিয়েছে একসঙ্গে থাকার সময়। আরও আরও কত স্মৃতি... সেই মধুপর্ণা,  নরম, সরম, মায়া জড়ানো, হাসিখুশি মেয়েটা এত নিষ্ঠুর ! ভাবতেও অবাক লাগে পরমার্থর

"দাদা, আপনাকে ডাকছে--"

চিন্তা সূত্র ছিঁড়ে যায়। পরমার্থ নীচে নেমে খাবারের বাটি তুলে নেয়। পরম যত্নে আলা ভোলা মেয়েটার মুখের লালা মুছিয়ে বলে, প্রাপ্তি মায়ের আজ আবার বাবির হাতে খাওয়ার সখ।

সেই কবে মধুপর্ণা খেলার ছলে পরমার্থর সিমেন টেস্ট করে জানায় তার শুক্রাণুর গঠন ত্রুটিপূর্ণ আর এটা জেনেটিক ডিসঅর্ডার।  অতি দামি ওষুধ ইনজেকশনেও সরানো সম্ভব নয়। রিপোর্টটা বিয়ের দুদিন আগে হাতে ধরিয়ে মধুপর্ণা হার্ভার্ড চলে যায়। হাইয়ার স্টাডিজ এর জন্য। উপহার স্বরূপ দিয়ে যায় তার ডিম্বাণুর ভল্ট নাম্বার।

'প্রাপ্তি' পরমার্থর সেই ভালোবাসার সন্তান যাকে সে বুক দিয়ে লালন করছে।

#######################

 

Tuesday 7 December 2021

অনিকেত--মৌ দাশগুপ্ত

*অনিকেত*
মৌ দাশগুপ্ত

পারুলগ্রামকে অজ পাঁড়াগা বললেও অত্যুক্তি হয়না। যদিও প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনায় পাকা রাস্তা হয়েছে, বিদ্যুতের খুঁটি বসেছে। কেবল চ্যানেল আছে।তবু নেই এর তালিকাও ছোট নয়।

সেই পারুলগ্রামের সবেধন নীলমণি মেয়েদের জুনিয়রস্কুলে যখন দেবারতি অঙ্কের টিচার হিসাবে জয়েন করলো তখন ওর চেনাপরিচিতরা খুব একটা আশ্চর্য হয়নি।অন্তর্মুখী স্বভাবের দেবারতি মুখে কিছু না বললেও কম বয়সেই পিতৃহারা মেয়েটা পিঠোপিঠি ভাইয়ের আত্মহত্যা, মায়ের অকালমৃত্যু, প্রেমে ধোঁকা খাওয়া, বিয়ের বছর না ঘুরতেই ডিভোর্স সব মিলিয়ে আবাল্য চেনা শহর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়াটাই যে বেছে নেবে, এটা যেন সবারই জানা ছিল। নয়ত ফলিত গণিতে পিএইচডি করতে করতে সব ছেড়েছুড়ে ওই রকম কেরিয়ার বেছে নেওয়াটা ওর মত মেধাবী মেয়ের কাম্য থাকতে পারেনা। চাপা স্বভাব বলে স্কুল কলেজেও দু একজন ছাড়া কারো সাথে সেরকম বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি, পারিবারিক দুর্ঘটনার পর আত্মীয়দের সাথেও যোগাযোগ রাখত না বিশেষ, নিজের বলতে কেউই ছিলনা মেয়েটার তাই কোন পিছুটানও ছিল না।তবু পারুলগ্রামে আসার ছয়মাসের মধ্যে যে দেবারতি ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করে বসবে তা বোধহয় কেউ ভাবতেও পারেনি। মরার আগে ডায়েরীর খোলা পাতায় একটা চিঠি লিখে গেছিল,

আমার শহরে কোন কাঁটাতারের বেড়া নেই,তবু আমরা রোজরোজ সাবধানী পায়ে সীমান্ত মেপে নিই।

আমার ভাই যেদিন বলেছিল পাশের বাড়ির রাবেয়াকেই বিয়ে করবে,সন্ধ্যারতির প্রদীপ ফেলে মা মুঠোভরা ধুতরার বীজ দেখিয়ে বলেছিলেন দু'জনের কোন একজনকে বেছে নিতে।অথচ মা মরা পাশের বাড়ির রাবেয়াকে আমার মা যত্ন করে চুল বেঁধে দিতেন, রান্না শেখাতেন,ওর অক্ষরজ্ঞানও হয়েছিল আমার মায়ের হাতে, আমার পুরানো স্লেটে।বোকা ভাইটা দুজনকে বাদ দিয়ে রেললাইনকে নিজের ভেবে জড়িয়ে ধরেছিল।সেদিন থেকেই দু'বাড়ির মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া উঠতে দেখেছিলাম। মা তারপরেও রাবেয়াকে দেখে চোখের জল ফেলতেন কিন্তু বেড়া ভাঙতে পারেননি।

মাকে হারিয়ে আঁকড়ে ধরেছিলাম কুষানকে, সংসার পেতেছিলাম, কিন্তু আমার ভজনের সাথে ওদের ক্রিশমাশ ক্যারলের সুর মেলেনি। ওর পরিবার ওকে তাই ছিনিয়ে নিয়ে গেল নিষিদ্ধ চৌকাঠ ডিঙানোর দায়ে।সেদিনও আরেক কাঁটাতারের বেড়া উঠতে দেখেছিলাম। রাস্তায় দেখা হয় দুজনের, আমরা হাসি, কথা না বলে এড়িয়ে যাই পরস্পরকে, বেড়া কিন্তু ভাঙে নি।


মনে মনে মেপে নিই নিজের বদলে যাওয়া চাহিদা,মাকে মনে পড়ে, ভাইকে, রাবেয়া, আর কুষাণকেও, আমার সেই চারদেওয়ালের ঘরকে। কিন্তু চোখ ফিরালেই চারপাশে নানা মাপের কাঁটাতার বেড়া,আমি যে আর বাড়ি ফেরার পথ খুঁজে পাইনা।"


স্কুলের নথি খুঁজে পাওয়া ঠিকানায় খবর গেছিল, ফাঁকা বাড়ি, কেউ থাকেনা, কি ভেবে তাও কদিন মর্গে শবদেহ রেখে দিয়েছিলেন থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার। যদিও বেশিদিন রাখতে হয়নি। তিনদিনের মাথায় দেবারতি ব্যানার্জি নামের ট্যাগ লাগানো বরফে শোয়ানো দেহটার সাথে চিঠিটাও তুলে দিয়েছিলেন শেষকৃত্য করতে আসা মেয়েটির হাতে, যে নিজের নাম বলেছিল রাবেয়া দেবাশীষ ব্যানার্জি।

Monday 6 December 2021

সম্পাদকীয়--



সম্পাদকীয়--
প্রকৃতি রং বদলায়--মানুষের মনও বুঝি একই ভাবে রূপান্তরিত হয় l বয়স বিভাজনের  সঙ্গে সঙ্গে ঋতুচক্রের ধারা পরিবর্তন জীবনের ধারার সঙ্গে মিলে মিশে যায় l পরিবর্তিত বয়সের, রূপ ধারা যেন অন্যরকম, সমস্ত সংযমের মধ্যে থেকে কখনো মনের বাগানের কোণে একটা ফুল ফুটে ওঠে, অলালায়িত, অবহেলিত, সে ফুল কবে যে ধুলোয় মিশে যায় সে খোঁজ বুঝি কেউ রাখে না l 
পৃথিবীর বুকে সব স্মৃতিচিহ্ন ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই সচেষ্ট থাকেন l মনের অজান্তে সৃষ্টির বৈঠা চলে, মাঝ গাঙের রুপালি মাছটা আলতো ধরে রাখা থাকে মনে l এই মন, এই দেহ, ভ্যানিশ পদার্থের এক মিউজিশিয়ানের সৃষ্টি বলে মনে হয় l এই চমক আবার গোধূলি শেষের ধূসর বেলার ছাই বর্ণ হয়ে মনকে বিষাদময় করে তোলে l
সৃষ্টি কোথাও থেমে নেই, আমি নেই, তুমি নেই, অথচ আছির মধ্যে দিয়ে বয়ে যাচ্ছি আমরা l  আজের ভাবনাগুলোর এক এক টুকরো নিয়ে তোমরা না হয় আগামী নব্য পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিও l আমাদের আজের গল্প কবিতা লেখনী সৃষ্টির কুচি কুচি পাতা নষ্ট বিবর্ণ ফাগুনের ধ্বংসাবশেষ থেকে তাকে না হয় তুলে নিও l সব কিছু না হয় ধোপদুরস্ত করে জুড়ে নিও আবার l
ক্ষরিত বালির জটলায় কংক্রিট জীবনের গাঁথুনিতে একটা অর্ধ মানুষের কষ্ট কষ্টিপাথর, সে ফসিল খুলে পড়ে নিও l তার বুক খুলে আশ্বিনের নবান্নর ছোঁয়া, গোধূলির বধুটির পেট চিরে সূর্যাস্তের সে সব খেলার খেয়াল জুড়তে থেকো, সে সব ক্ষয়িত ভাষা, সে সব পতিত সংলাপ, সে সব দৌরাত্ম্য পতনের পরিণতিগুলি সব ভাঙাচোরা থেকে আবার তৈরি হবে সৃষ্টির কলম, আকাশের কাগজে তোমায় দেবো প্রেমপত্র, আলতো ছোঁয়াগুলি প্রেমিকার বুকে তোলপাড় তুলে আবার আসুক না ফিরে তোমার কাছে l
এবার রাখি ভাব-ভাষার পাগলামি l 
আসুন সৃষ্টির কলমে কতটুকু এগুলো আমাদের  বর্ণালোক ? কতটা ভাব ভাবনা পাঠকের মন কেড়ে নিতে পারল? ভালো-মন্দের টানাপোড়েনে কতটা উদ্ভিন্ন কাহিনী আমাদের জীবনে শান্ত অশান্ত বিভ্রান্ত বিকৃতি এনে দিল? মনের মাঝে, 
ভাষার দৃষ্টিকোণে, শৈলীর বিভাজনে, সৃষ্টির পরিপাটি নৈপুণ্যে কোন কোন লেখক খুলে দিতে পারলেন পাঠককুলের মনের দরজা? 
পাঠকবর্গের প্রতি আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, আপনারা বর্ণালোক পড়ুন l বর্ণ, মাধুর্য মেতে উঠুন l আপনারা ভুল-ত্রুটিতে  সোচ্চারিত হোন, ভালোকে ভালো, মন্দকে মন্দ বলে পথ প্রদর্শন করুন l এতেই আমরা ঋদ্ধ হবো l ধন্যবাদান্তে--সম্পাদক--তাপসকিরণ রায় l

সহ:সম্পাদকের কলমে--
কিছু শারীরিক অসুস্থতার জন্য এবার আমার লেখা দেওয়া হলো না। আবার সব সংখ্যায় আমি লিখব সেটাও হয় না। আপনাদের লেখায় সম্বৃদ্ধ হয়ে উঠছে পত্রিকা দিনকে দিন।--শমিত কর্মকার।

সহ সম্পাদকের কলমে--
হেমন্ত আসে ফসলের ডালি নিয়ে। হেমন্তে ফসল কেটে ঘরে তোলার পালা। ধূসর হেমন্তের দিনে  তাই ভরে যায় চাষির ধানের গোলা। গোলা ভরা ধানের দিকে তাকিয়ে আনন্দে মেতে ওঠে  মানুষের  মন। আকাশ বাতাস সুরভিত নবান্নের সৌরভে,গ্রামের মানুষের মন  আমোদিত নূতন ধান, দুধ ,গুড় ,আদা, ফল-ফুলুরি দিয়ে পূজো আর উৎসবের অব্যাহত আমন্ত্রণে।সকলের জন্য রইল শুভেচ্ছা।পাকা ধানের সোনালী রঙের আবহে সবাইমেতে উঠুক নবান্নের সৌরভে। আমরাও নাহয় ততক্ষণে মেতে উঠি সুন্দর সুন্দর অণুগল্পের সৌরভে।-- সাবিত্রী দাস l

খরগোশ আর জাদুকরের গল্প--জয়িতা ভট্টাচার্য




খরগোশ আর জাদুকরের গল্প 
জয়িতা ভট্টাচার্য 

একটা গ্রামে কিছু মানুষ বাস করত।কেউ কুমোর,কেউ কামার,কেউ চাষী,কেউ ঘরামি। গ্রামের পাশে একটা নদী ছিল আর নদীর ওপারে বন। দু একজন কখনও সখনও ওপারে যেত মধুর লোভে,বন মোরগের মাংসের  লোভে।কেউ ফিরে আসত কেউ যেত বাঘের পেটে।
একদিন যখন লাল সূর্যের প্রথম রশ্মিটা দেখা গেল কালচে একটা মানুষের ছায়া পড়ল গ্রামে।সে সেই গ্রামের শেষে একটা কুটির বেঁধে বাস করতে শুরু করল। ওদিকটা ছিল বাদা অঞ্চল কেউ বিশেষ যেতো না।তবুও এক দুজন উঁকি ঝুঁকি দিতে যারা গেল তারা ফিরল না।কোনো খবরই পাওয়া গেল না। গ্রামের সর্দার সাহস করে লাঠি সোঁটা নিয়ে একদিন তার সঙ্গে  আলাপ করতে গিয়ে জানল সে জাদুকর।জাদুর বলে সে অনেক কিছুই করতে পারে এমনকি মানুষকে খরগোশ করে দিতে পারে। 
গ্রামে মাঝে মধ্যেই মানুষ নিরুদ্দেশ আর খরগোশ আর ছাগল বাড়তে লাগল। লোকের মনে এই প্রথম ভয় হলো। মনের শান্তি নষ্ট হলো।চাষবাস মাথায় উঠল।জাদুকর সেখানের রাজা হয়ে বসল।যা কিছু গ্রামের সম্পদ ছিল সব সে হস্তগত করে নিল। তার বদলে দুবেলা তারা খেতে পেল।গ্রামে আর চাষা নেই, কুমোর নেই ,ঘরামি নেই ,সকলেই তখন বাঁচতে পারলেই শান্তি পাবে যেন। সকলকেই জাদুকর ভিখারি করে দিল। খরগোশ করে দিল,ছাগল করে দিল।তাদের আর কাজ নেই।খিদে পেলে যা দেয় জাদুকর তাতেই তারা খুশি আর সারাদিন ঘুরে বেড়ায়। ওরা ধীরে ধীরে সবাই জাদুকরের মন্ত্রে খরগোশ কিম্বা ছাগল হয়ে গেল।
এরপর মানুষের সন্তান সন্ততি কেবল খরগোশ আর ছাগল হয়ে জন্মায়।জাদুকরের মায়ায় তারা  দুবেলা যেটুকু  পায় তাতেই সন্তুষ্ট হয়ে যায়। ঋতু  পাল্টায়, জন্ম আর মৃত্যু হয়।জাদুকরের শক্তি কমে আসে ,সে বৃদ্ধ হয় কিন্তু কারো আর মনে হয় না জাদুকরকে তাড়িয়ে দেবার কথা, মেরে ফেলার কথা কারন তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ঘাড় হেঁট করে ভিক্ষা করতেই আরাম বোধ করে।তারা যে মানুষ তা একদিন সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে যায়।

শব্দের জানালা--তাপসকিরণ রায়



শব্দের জানালা 
তাপসকিরণ রায়

বর্ধমানে আমার এক জ্যাঠামশাই থাকতেন l আমি প্রায় প্রতিবছরই সেখানে ঘুরতে যেতাম l সেখানে আমি জ্যাঠতুতো ভাইবোনদের সঙ্গে মিলে মিশে যেতাম l তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি ।
আমরা গেলে জ্যাঠামশাই খুব খুশি হতেন l  আনন্দ প্রকাশের মধ্যে দিয়ে তার চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসত l তার ভালবাসার আবেগ আমাদের ছুঁয়ে যেত l
আমি প্রায়ই একটা জিনিস লক্ষ্য করতাম, রাতের নির্জনতায় জ্যাঠামশাই একলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন l মনে হত, ফিসফিস করে কারো সঙ্গে তিনি কথা বলতেন--মনে হত তিনি কিছু শুনতে পাচ্ছেন, সে সব শব্দের অর্থ কি তিনি খুঁজে ফিরতেন ? আবার আমাদের সামনে পেয়ে তিনি খুব খুশিও হতেন l
জ্যাঠামশাইয়ের বয়স হয়েছিল, আশির কাছাকাছি l এখনো তিনি উচ্ছল, প্রাণবন্ত, আবেগপ্রবণ আনন্দের মধ্যে কোন গভীরতা থেকে তার কান্না বেরিয়ে আসতো, অশ্রুধার কান্না ।
বয়স হলে মানুষ বুঝি অনেকটাই এমনি হয়ে যায় l কারো মধ্যে প্রকাশ বেশি, অনুভব আবেগ বেশি, অশ্রুত কান্নার ভিড় তাদের চোখে এসে জমে থাকে ।
একটা অদ্ভূত ভাবনার মধ্যে হাসি আনন্দের সঙ্গেই তার কান্নার উৎস ফুটে উঠত ! আসলে মানুষের বুঝি একটা বয়স থাকে তার সীমানায় এসে গণ্ডীবদ্ধ সে জানে আর বেশি দিন এই পৃথিবীতে সে নেই ! আর এ কারণেই বুঝি অন্য অজানা এক পৃথিবীকে সে আগেভাগেই চিনে নেবার চেষ্টা করে l তার পরিবেশকে বুঝে নিতে সার্থক অথবা ব্যর্থ চেষ্টায় অনুপ্রাণিত হয় l
প্রায় সময় জ্যাঠামশায়ের বাড়ী আমরা দু-তিনদিন থেকে আবার ফিরে আসতাম l জ্যাঠামশাই আমাদের নিয়ে বেশ হাসিখুশি থাকবেন l এমনি একবার আমরা ফিরে আসব, জ্যাঠামশাই অঝোরে কাঁদতে থাকলেন, বলতে লাগলেন, হ্যাঁ, বাবারা কে জানে আর কোন দিন তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে কিনা ! 
জ্যাঠামশাই কথা বলতে পারছিলেন না, চোখের জলে সবাইকে দেখতে চাইলেন তিনি, সবার সঙ্গে কথা বলে তিনি সরে গেলেন--অপেক্ষমান খোলা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন l
বাইরের হাওয়া জানালা ভেদ করে ঘরের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল l অস্পষ্ট , ক্ষীণ শব্দ আসছিল, জ্যাঠামশাই সে শব্দ যেন কান পেতে শুনছিলেন l সে শব্দের বার্তার এক দিকে বেজে উঠছিল--যেতে নাহি দিব...অন্যদিকে যাবার নিশ্চিত একটা তাগিদ জ্যাঠামশাই স্পষ্ট যেন টের পাচ্ছিলেন l
সমাপ্ত

Sunday 5 December 2021

প্রার্থনা--সন্ধ্যা রায়



প্রার্থনা 
সন্ধ্যা রায় 

অনেকেই বলে মনে কখনো অহংকার এলে একবার শ্মশানে ঘুরে আসবেন l আমার মনে হয় একবার হাসপাতালে যাওয়া সব চাইতে ভালো l ওখানে গেলে জীবনকে চেনা যায়, এখন ভালো আছি, কাল কি হবে? তা কেউ জানে না l সামনে নানা অনুভূতির জন্ম হয় যা নিজের চোখে দেখা যায়। নানা বিস্ময়কর অনুভূতির সমন্বয় ঘটে । --চলুন ম্যাডাম, আমি ধরে উঠিয়ে দিচ্ছি, বসুন হুইল চেয়ারে, আপনাকে এক্স-রে করাতে নিয়ে যেতে হবে-- 
নার্সের সাহায্য নিয়ে আমিও উঠে বসলাম, চললাম নার্সের সাথে, ভেতরে পৌঁছে দাঁড়িয়ে আছি। আমার আগের জনের এক্সরে হচ্ছে, তারপরই আমার চান্স । হঠাৎ এক ইমারজেন্সি পেশেন্ট এলো, তার নাকে নল, মুখে ব্যান্ডেজ, ইউরিনের টিউব-প্যাক্ লাগানো l মনে হল তার প্রাণটা নিমেষে উড়ে যেতে পারে, সব শেষ হয়ে যেতে পারে l দেখেই কেমন ভয় হচ্ছিল, ঠাকুর সবাইকে ভাল করে দিও--আমি দুহাত তুলে প্রার্থনা করলাম l একটা পঁচিশ ত্রিশ বছর বয়সের ছেলে, ওর জীবনের সব পড়ে আছে, আমার তো সব শেষ করে এসেছি, ইমারজেন্সি পেশেন্টের এক্সরে আগে নেওয়া হল l তারপর আমার সময় আসবে l 
এক্স-রের পরে আমি আমার নিজস্ব হসপিটালের ঘরটিতে চলে এলাম l এই সব দেখে আমি বড় ক্লান্ত, খাওয়া হল, আবার ড্রিপ চলল l আমি ঘুমিয়ে নিয়ে শান্ত হলাম l বিকেলে আবার আলট্রা সাউন্ড এর জন্য গেলাম l ওখানে কোন ভিড় নেই, আমার কি হয়েছে তখনও আমি জানি না l, আমার আল্ট্রাসাউন্ড চলাকালীন তা গুটিকতক স্টুডেন্টকে দেখানো হল l ডক্টর তাদের সামনে খুব শিক্ষামূলক ব্যাখ্যা করলেন হিন্দিতে আর ইংরেজিতে , তার এসব এখানে কিছু আমি দিলাম না l পরদিন আবার অন্য একজন নার্স তার সঙ্গে গেলাম সিটিস্ক্যান করাতে l অন্য দিনের মতই দাঁড়িয়ে আছি, কারো সিটিস্ক্যান চলছিল, সে বেরোলেই আমি যাব l ওখানে এক সুন্দরী মেয়ে, বছর পনের ষোলর হবে, ওর কি রোগ ছিল আমি জানি না l আমাকে দেখেই মেয়েটি আমার পাশে এল, জিজ্ঞাসা করল, তোমার কি হয়েছে গো ? আমি বললাম, জানি না কি হয়েছে l আমার আসলে এতকিছু বলার ক্ষমতাও ছিল না l আমি তাই এড়িয়ে গেলাম l আমাকে ও বলল, তুমি ভালো হয়ে যাও! আমার মার তো ক্যান্সার হয়েছিল, মারা গিয়েছে l আমি ওখানে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলাম l এত কষ্ট মেয়েটার! কি জানি কি হয়েছে ! 
আমি ভিতরে গেলাম, তারপর পঁয়ষট্টি বছর বয়সে আমার প্রথম সিটিস্ক্যান হল l আবার হসপিটালের নিজের রুমে চলে গেলাম l কিন্তু মনে হতে থাকলো, মেয়েটার মার ক্যান্সার ছিল , আমারও বায়োপসির জন্য গেছে, কি রিপোর্ট আসবে কে জানে? কখন যেন ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম l হাসপাতালের তাড়নায় ঘুম কিন্তু ভালই হয় l পরদিন রিপোর্ট বোধহয় এসে গিয়ে ছিল, সকাল থেকে জল খেতে দেয়নি, নিয়ে গেল ওটিতে l ওখানে গিয়ে দেখি এক সাড়ে তিন বছরের শিশু ওর সামনে টয়ট্রেন সাজানো l বেডের উপর খেলছে সে l মনে হল এই বাচ্চাটা এল কেন এখানে ? নার্সকে জিজ্ঞাসা করতেই বললো, ওর ব্রেন টিউমার l মনে মনে আমি , অবাক হলাম, এত ছোট বাচ্চার ব্রেইন টিউমার হয়? তখন  আমার মনে সারদা মা ও ঠাকুরের মুখটা ভেসে উঠলো l  
--তুমি তো আমাকে অনেক সুখ দিয়েছো, মা ! আমি পঁয়ষট্টি, এসেছি এই হাসপাতালে, এত ছোট বাচ্চার কি অপরাধ মা, কেন এমনি হল ! আমার চোখ থেকে জল বেরিয়ে এলো l আমি তাকিয়ে দেখি, শিশুটা অপলক তাকিয়ে আছে আমার দিকে l আমি নিজেকে সংবরণ করে একটা হাসি দিলাম--মায়ের উদ্দেশ্যে হাত উঁচু করে বারবার প্রণাম করলাম l বললাম, ভালো করে দাও এই শিশুটাকে--
আমি তো বয়সে বুড়ো হয়ে এসেছি আমি নিজের সব কষ্ট ভুলে যাব মা, ওকে ভালো করে দিও তুমি! যেন এই পৃথিবীর আলো বহুদিন সে দেখতে পায় l 
এম.আর.আই. হল l ভিড় নেই একদম--এক ঘন্টার উপরে সময় লাগলো l আজ আর মনকে নাড়া দেওয়ার মতো কোনো ঘটনা নেই l ফিরছি রুমের দিকে, হঠাৎ কান্নার আওয়াজ এলো l সামনে দিয়ে, স্ট্রেচারে একজন ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছে--দু জন স্ত্রীলোক একজন পুরুষ লোক কান্নায় ভেঙে পড়েছে l বুঝলাম, ছেলেটি মারা গেছে, মুখটা তার তখনও সাদা কাপড়ে ঢাকা হয়নি l মা বাবা আর স্ত্রী শেষ দেখার জন্য সুযোগ পেয়েছে l আন্দাজেই আমি বুঝে নিয়েছিলাম l আমি জানি না বা চিনি না--তবুও কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম মৃতদেহ দেখে l  নার্সকে বললাম, একটু , দাঁড়াও , আমি দুহাত তুলে প্রণাম করলাম মৃতের উদ্দেশ্যে--খুব সুন্দর ছেলেটাকে দেখতে l দেখে মনে হল যেন শ্রী  নারায়ণ সমুদ্র শয়ানে l আমার নিজের প্রতি ঘৃনা হল, আমি নিজের জন্য কাঁদি তার চেয়ে এই সব ছেলেদের আরও প্রাণ দিও, ঠাকুর, জীবনী শক্তি তাদের মধ্যে আরও দাও ঠাকুর ! এইসব প্রাণকে রক্ষা করো, আরো অনেক অনেক দিন এদের সময় দিও! কিছুই হয়নি জীবনে তার, হয়ত মাত্র শুরু করেছিল, এখানেই শেষ করে দিও না ঠাকুর l
সমাপ্ত

মানিকজোড়--সমাজ বসু



মানিকজোড়
সমাজ বসু

ছেলেদুটোর জ্বালায় অতিষ্ট রমা দেবী। বাড়িতে একাই থাকেন। ছোট্ট একটা বাগান লাগোয়া বাড়ি। ফুলের বড় শখ তাঁর। তার পেছনে তিনি অনেকখানি সময় ব্যায় করেন। ফলস্বরূপ বিভিন্নরকম ফুলে ভরে উঠেছে তাঁর বাগান। এছাড়া দুতিনটে পেয়ারা,আম আর বাতাবিলেবুর গাছও আছে। কিন্তু ওই বাঁদর দুটোর উৎপাতে গাছে না ফুল থাকে,না ফল। কখন যে ওগুলো নিয়ে পালায় টেরই পান না। 
--- হ্যারে বাসন্তী,ওই বিচ্ছু ছেলেদুটোর কি করি বল তো?আজ এটা ভাঙছে,কাল ওটা ভাঙছে। ফুল ফল নিয়ে পালাচ্ছে। আমার হাড়মাস এক করে ছাড়ল। 
--- দ্যাখো গিন্নিমা, আমার তো মনে হয় এবার তুমি পাড়ার কিছু বড়দের কানে কথাটা তোলো। তোমার পক্ষে ওদের শায়েস্তা করা সম্ভব নয়। তাই পূজোর পর দাদাবাবু এলে,এর একটা বিহিত করো।
--- হ্যা,এবার একটা কিছু করতেই হবে। এই তো কাল ভেবেছিলাম,আজ ঠাকুরকে একটা বাতাবিলেবু প্রসাদ দেবো। সকালে উঠে দেখি, চারটের একটাও নেই। মন খারাপ হয় কিনা বল? তুই ঠিকই বলেছিস,বাবলু এলে কিছু একটা‌ করতে হবে।

আজ মহাষষ্ঠী। শরতের ঝকঝকে তকতকে আকাশ। বাতাস জুড়ে মায়ের আগমনীর সুরধ্বনি।  এই মনোরম পরিবেশেও রমা দেবীর মন ভালো নেই। ছেলে ছুটি পায়নি। দশমীর আগে সে আসতেই পারবে না। এবার আর মায়ের মুখ দেখা হবে না। এইকটা দিন টিভিতেই দর্শন সেরে নিতে হবে। একটা কষ্ট তাঁর বুকে জাঁকিয়ে বসল।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমে এলো। পাড়ার পূজোমন্ডপ থেকে ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসছে। বারান্দা থেকে বড় রাস্তায় লোকজনের যাওয়া আসা দেখতে দেখতে রমাদেবী পূজোর গন্ধ অনুভব করতে লাগলেন। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠল। পায়ে পায়ে নীচে নেমে এসে দরজা খুলতেই তিনি একেবারে অবাক। ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন। দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে কালু আর রঘু। মানিকজোড়।
--- একি! তোরা এখন? কেন এসেছিস? কি চাই তোদের?
--- আমাদের কিছু চাই না ঠাকুমা। কাকু তো বাড়িতে নেই। তাই আমরা এসেছি, তোমাকে পাড়ার ঠাকুরগুলো দেখাব বলে। একটা রিকশাও নিয়ে এসেছি। কালু আর রঘুর কথা শেষ না হতেই,রমাদেবীর চোখদুটো ছলছল করে উঠল। তিনি পরম স্নেহে দুহাত দিয়ে দুজনকে কাছে টেনে নিলেন। সব কথা যেন তাঁর গলায় আটকে আছে।
--- নাও ঠাকুমা,এখন খুব তাড়াতাড়ি কাপড় পরে নাও দেখি। আমরা নীচে অপেক্ষা করছি। কালুর কথা শেষ হতেই রঘু সুর ধরল।
--- ঠাকুমা,পূজোমন্ডপে কিন্তু আমাদের আইসক্রিম খাওয়াতে হবে।
--- শুধু আইসক্রিম কেন? আজ তোরা যা খেতে চাইবি‌,তাই খাওয়াব। ওরে,আমি যে তোদের চিনতে পারিনি। আজ থেকে তোরা দুই মানিকজোড় আমার দুচোখের দুটো মণি হয়ে গেলি। সঙ্গে সঙ্গে ওরা দুজন একসঙ্গে ঢিপ করে রমাদেবীকে প্রণাম সেরে নিল।
পাড়ার পূজোয় তখন মায়ের আমন্ত্রণ শুরু হয়ে গেছে। একসাথে অনেক ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসছে।

প্রাপ্তি--অদিতি ঘটক

প্রাপ্তি অদিতি ঘটক কেসটা সাজাতে গিয়ে বারবার তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, অথচ হাতে সময় খুব কম। তাড়াতাড়ি এফ. আই. আর. এর খসড়াটা  তৈরি করতে হবে। পরমার্...